সমুদ্রপৃষ্ঠে বিমানবন্দর সম্ভাবনার নবদিগন্ত

Passenger Voice    |    ১১:১২ এএম, ২০২১-১০-০৬


সমুদ্রপৃষ্ঠে বিমানবন্দর সম্ভাবনার নবদিগন্ত

বিগত ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজের উদ্বোধন করেন। এই বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সমুদ্রের মধ্যে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কিছু কথা বলেন, দেশের জন্য যেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ‘কক্সবাজার হবে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকত, পর্যটন কেন্দ্র ও অত্যন্ত আধুনিক শহর। সরকার দেশের ভৌগোলিক অবস্থান কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে চায়। পৃথিবীতে কক্সবাজারের মতো স্যান্ডি বিচ কম আছে। সেখানে বিদেশিদের জন্য বিশেষ অঞ্চল করে দেওয়া হবে, যাতে তারা তাদের মতো করে উপভোগ করতে পারেন। কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ হলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে যত বিমান যাবে, এটি হবে তাদের রিফুয়েলিং-এর জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গা।’

যে কোনো দেশের ভৌগোলিক অবস্থান তার নাগরিকদের জীবন মানের উন্নতি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিনিয়োগের উর্বর ক্ষেত্র সরবরাহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে এর জন্য প্রয়োজন হয় সরকারের নীতি সহায়তা, পৃষ্ঠপোষকতা এবং লাগসই অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এই ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা কাজে লাগানোর ফলে কোনো কৃষিজ ও খনিজ সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও মালদ্বীপ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে উচ্চতর মাথাপিছু আয়ের দেশ; তাদের মাথাপিছু আয় ১০,৬২৬ (২০১৯) মার্কিন ডলার। মালদ্বীপের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনসহ সেবা খাত; এই খাতের অবদান জিডিপিতে ৭৩ শতাংশ এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে ৬০ শতাংশ। মালদ্বীপের প্রতিটা অভিগম্য দ্বীপকে ছবির মতো একেকটা রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রায় ১২০০ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপের দুই শতেরও কম দ্বীপে মানুষের বসতি রয়েছে। অথচ সেখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই আছে ৪টি; অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের সংখ্যা ১৩/১৪টি, জলপথে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়ার সুব্যবস্থা তো আছেই। উড়োজাহাজ থেকে মালদ্বীপের সবুজ জলবেষ্টিত যে কোনো বিমানবন্দরে অবতরণ করার অভিজ্ঞতা চরম উত্তেজনাকর। এই চমৎকারিত্বই অধিকাংশ পর্যটকের কাছে মালদ্বীপে ভ্রমণ উন্মত্ততার পেছনে কাজ করে।

ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম সম্পদশালী প্রদেশ বালির রাজধানী দিনপাসার-এ অবস্থিত নগুরারাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য ১৯৬৩ সালে প্রকল্প গ্রহণ করে দূরবর্তী উৎস থেকে সংগ্রহ করা বালি ও চুনাপাথর দিয়ে বিমানবন্দর সংলগ্ন সাগরতীরে ভূমি উদ্ধারের পর অতিরিক্ত ১৫০০ মিটার রানওয়ে সংযোগ করা হয় এবং তারপর এটাকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। পর্যটন শিল্পের বিকাশে গতি দিতে ইন্দোনেশিয়ার তৎকালীন জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ বালিতে বালি বিচ হোটেল গড়ে তোলেন। ২০১৭ ‘ট্রিপএডভাইজর’-এর (tripadvisor) মূল্যায়ন অনুযায়ী বালি ছিল বিশ্বে পর্যটনের শ্রেষ্ঠ গন্তব্য। ২০১৯ সালে বালির মাথাপিছু আয় ৪,১১৯ মার্কিন ডলার। এর অর্থনীতির ৮০ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখন এই বিমানবন্দর আরও সম্প্রসারণ ও আধুনিক করা হয়েছে এবং সমুদ্রের অগভীর অংশের ওপর দিয়ে বিমানবন্দরের সংযোগ সড়কের নয়নাভিরাম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এখনকার সুসজ্জিত ও সুপরিকল্পিত সিঙ্গাপুর চাঙ্গি বিমানবন্দর নির্মাণ করতে অন্তত ৮.৭ বর্গ কিলোমিটার ভূমি সাগর ও জলাভূমি থেকে উদ্ধার করতে হয়। তারপর ১৯৮১ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ‘স্কাইট্র্যাক্স’-এর (Skytrax) এর মূল্যায়নে এই বিমানবন্দর বর্তমানে উপর্যুপরি আট বছর ধরে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিমানবন্দর। ২০২৫ সালের মধ্যে এই বন্দর আরও সম্প্রসারণ করে ৫ম টার্মিনাল নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে, যেটির আয়তন হবে এর ২য় ও ৩য় টার্মিনালের যোগফলের চেয়েও বেশি। এখন সিঙ্গাপুরের প্রধান রপ্তানি পণ্য ইলেক্ট্রনিক্স, রাসায়নিক ও সার্ভিস হলেও এর বিকাশ ঘটে ‘entrepot’ বা আড়ত হিসেবে; যার কাজ মালামাল আমদানি করে এনে প্রক্রিয়াজাত শেষে আবার রপ্তানি করা। এই সুবিধার কারণে সিঙ্গাপুর এশিয়ায় পেট্রোলিয়াম ব্যবসা ও পেট্রোলিয়াম পরিশোধনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বর্তমানে সিঙ্গাপুর হিউস্টন ও রোটারড্যামের পর ৩য় বৃহত্তম তেল পরিশোধন কেন্দ্র এবং নিউইয়র্ক ও লন্ডনের পর ৩য় তেল ব্যবসা কেন্দ্র। সিঙ্গাপুরের পর্যটনবান্ধব নীতি, অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার কারণে ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রচুর বিদেশি পর্যটকের সমাবেশ ঘটে; ২০১৯ সালে সেখানে ১৯.১০ মিলিয়ন পর্যটক আগমনের হিসাব পাওয়া যায়। এই দ্বীপরাষ্ট্রের আরেক ক্ষুদ্র দ্বীপ সেন্তোসা। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য সেখানে মাটির ওপরে-নিচে যে কত রকমের ব্যবস্থা রয়েছে, তার হিসাব করা কঠিন। সাইট সিয়িং, ডাইভিং, স্নরক্লিং, চিত্তবিনোদন, প্রমোদভ্রমণ, ক্যাসিনো, খাদ্য ও পানীয়, আবাসন, শপিং কী নেই সেখানে! সিঙ্গাপুরের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ৪ শতাংশ।

আরো পড়ুন: পাইলট নওশাদের পেশাদারিত্ব ও দায়িত্ববোধ

এশিয়ান ডলার মার্কেট হিসেবে সিঙ্গাপুরের অভ্যুদয় ভৌগোলিক সুবিধার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রতিদিন আর্থিক বিশ্বের কাজ শুরু হয় জুরিখ থেকে সকাল ৯টায়, এরপর ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লন্ডনে। সন্ধ্যায় ইউরোপ বন্ধ হয়ে গেলে কাজ হস্তান্তরিত হয় নিউইয়র্কে। এরপর সানফ্রানসিসকো ঘুমিয়ে পড়লে সারা বিশ্বের আর্থিক কর্মকাণ্ডের যবনিকা পতন হয়। পরদিন সুইস সময় ৯টা পর্যন্ত সে পর্দা অনুত্তোলিত থাকে। সিঙ্গাপুর যদি এই চক্রের মিসিং লিঙ্ক হিসেবে যুক্ত হয়, তবে বিশ্বব্যাপী ২৪ ঘণ্টার নিরবচ্ছিন্ন আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের লেনদেন চালু রাখা সম্ভব। এই বোধোদয় থেকে ১৯৬৮ সালে সেখানে এশিয়ান ডলার মার্কেটের গোড়াপত্তন হয়। এখন বৈদেশিক মুদ্রার বাজার হিসেবে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ও টোকিওর পর সিঙ্গাপুরের অবস্থান চতুর্থ।  এতগুলো দৃষ্টান্ত দিয়ে পাঠককে ভারাক্রান্ত করার কারণ এই যে, শুধু ভৌগোলিক সুবিধা ও সম্পদ থাকাই যথেষ্ট নয়, সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার ও উন্নয়ন সাধন করার মাধ্যমেই কেবল দেশ ও জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে সেসব কাজে লাগানো যায়। কক্সবাজার দেশের পর্যটন শিল্পের এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। সেখানে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১০,৭০০ ফুট দীর্ঘ রানওয়ে নির্মিত হচ্ছে, যার মধ্যে ১,৩০০ ফুট থাকবে সাগরের বুকে। এটি দেশের জন্য অবশ্যই একটি আশা-জাগানিয়া বার্তা। প্রধানমন্ত্রী আশা করেছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে যে সব বিমান উড়াল দেবে, সুবিধাজনক হওয়ায় তার অধিকাংশই এখান থেকে রিফুয়েলিং করবে। আমার ধারণা, শুধু রিফুয়েলিং না, অবকাঠামো গড়ে তোলা হলে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা গেলে কক্সবাজার হয়ে উঠতে পারে সিঙ্গাপুরের মতো একটি ব্যস্ত রিফুয়েলিং কেন্দ্র, সম্ভাবনাময় ‘এনট্রেপট’ বা আড়ত ও আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য।

পর্যটনের সুবিধা হলো এটি একটি শ্রমঘন শিল্প; এ খাতের আয় মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় না, সবার কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চলে যায়; বণ্টন হয় সমমাত্রিক। ফলে সমাজে আয়-বৈষম্য কমাতে এটার জুড়ি নেই। সমাজের নানা পেশার মানুষ এর ভাগ পায়; ধোপা-নাপিত থেকে শুরু করে নটনটী সবাই এর অংশীদার হয়। এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ই তার প্রমাণ; ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে পর্যটন’। তাছাড়া পর্যটনে স্থানীয় চারু ও কারুপণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়। প্রতিটা পর্যটক নতুন কোনো জায়গায় ভ্রমণে গেলে সেখানকার কৃষ্টি ও কলার চিহ্ন বহন করে নিতে চায়। দীর্ঘদিন ধরে পর্যটনের কাশী হিসেবে পরিচিত বালিতে চারু ও কারুকলার যে বিকাশ ঘটেছে, তা দেখে মানুষ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কাঠ, পাথর, মাটি, ফেব্রিক্স দিয়ে ওখানকার শিল্পীরা তাদের নিপুণ হাতে যে চারু ও কারুপণ্য তৈরি করে, সেগুলো দেখে শুধু যে নয়ন জুড়াতে ভালো লাগে, তাই না, কিছু কেনাকাটা করে হৃদয়ের দাবিও সামলাতে হয়। একটি কাঠের ঘোড়ার প্রেমে পড়ে বিমানে পরিবহনের সমস্যা সত্ত্বেও আমি নিজেই একবার একটি বড় কাঠের বাক্সে ভরে সেটাকে সহযাত্রী করে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম।

পর্যটনের আরও সুবিধা হলো এটা মানুষের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি মন ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা ঘটায়, মানুষকে কূপম-ূকতা থেকে উদ্ধার করে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যায়। নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষের সংস্পর্শ পরস্পরকে পরমত ও পর-সংস্কৃতি সহিষ্ণু করে তোলে; সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ ও বিকিরণের মাধ্যমে মানুষকে একীভূত হতে সহায়তা করে। অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনো আমাদের দেশের অনেকে সাধারণ পোশাকে নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া এবং আয়-উপার্জন করাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না। অথচ মালদ্বীপ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার মেয়েরা চৌকস পোশাক পরে পর্দা পালন করছে এবং হোটেল ও রিসোর্টে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে। মালয়েশিয়াও একটি মুসলিম দেশ, কিন্তু পর্যটনের উন্নয়নে গেন্টিং হাইল্যান্ডে ক্যাসিনো চালু করা হয়েছে অনেক আগেই, যেখানে স্থানীয় মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ। আবার সেখানকার জাতীয় মসজিদে (মসজিদ নাগারা) গাউন পরে বিদেশি নারীরা প্রবেশ করতে চাইলে তাতেও কোনো সমস্যা নেই। মালদ্বীপ ও বালিতে আইনত ক্যাসিনো পরিচালনা অবৈধ; কিন্তু হোটেলের মধ্যে বিদেশিদের এ কাজে তেমন কোনো বাধাবিপত্তি নেই।

আমাদের দেশ দ্রুত উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে; অনেক মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে, বিদেশিদের জন্য নিবেদিত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে, সেগুলোতে অনেক বিদেশি কর্মী কাজ করছেন। দেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক ভিনদেশি এদেশে কাজ করতে এবং দেশ দেখতে আসবেন। তাদের চিত্তবিনোদন, আমোদপ্রমোদ, পানাহার, ফ্যাশন ও পোশাক-পরিচ্ছেদের প্রকৃতি ভিন্ন। বিশ্বে চিত্তবিনোদন এখন অন্যতম মৌলিক চাহিদা হিসেবে গণ্য। কাজেই আমাদের অর্থনীতির স্বার্থে মালয়েশিয়ার মতো যদি তাদের আমোদ-প্রমোদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা যায়, তাতে কোনো ক্ষতি নেই, বরং লাভ হবে। একবার এই সুবিধার আস্বাদন শুরু হলে তার গুনক প্রভাবে অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। কক্সবাজারেও এখন চাঙ্গি ও দিনপাসার বিমানবন্দরের মতো সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকিং শিল্পগুলো যত তাড়াতাড়ি বাস্তবে রূপ নেবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল হবে।

লেখক খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কলামনিস্ট